সাত গ্রামের ডাক্তার

অনেকদিন আগে একজন ডাক্তার ছিল, প্রত্যন্ত গ্রামে তার বাড়ি। সে এম.বি.বি.এস ডাক্তার না কিন্তু এম.এল.এফ ডাক্তার। আশেপাশের ৭ গ্রামে একজন মাত্র ডাক্তার, দূরে এক গ্রামে একজন ডাক্তার আছে সেও আসলে কমপাউন্ডার। আশেপাশের সব গ্রামের মানুষ চিকিৎসার জন্য এই ডাক্তারের কাছেই আসতো। তার বাবা আয়ুর্বেদ চর্চা করতেন কবিরাজ হিসেবে ভালো নাম ছিল। নিজের এক মাত্র পুত্রকে তাই কলকাতা পাঠিয়ে এম.এল.এফ পড়িয়ে ছিলেন। শত শত মানুষের বাঁচা আর আশার আলো এই ডাক্তার। তার জীবনে কোন ছুটি নেই, উনি ছুটি নিলে এই মানুষ গুলো কোথায় যাবে?

বয়সের সাথে ডাক্তার বাবু নিজেও কিছুটা অসুস্থ হয়ে গেলেন। এক সময় বুঝতে পারলেন উনার চিকিৎসার জন্য একজন বড় ডাক্তারের কাছে যাওয়া প্রয়োজন। বড় ডাক্তার মানেই তখন কলকাতা যেতে হবে, কলকাতা ছাড়া এই অঞ্চলে তখন এম.বি.বি.এস ডাক্তার ছিল না। সত্যি বললে ভারতবর্ষে জুড়েই খুব বেশি এম.বি.বি.এস ছিল এমন না। ডাক্তার বাবু নিজের সর্বোচ্চ জ্ঞানের ব্যবহার করে চেষ্টা করে যাচ্ছেন সুস্থ হওয়ার কিন্তু শরীর ঝিমিয়ে যাচ্ছে।


Photo Copyright Ontaheen.com


এর মধ্যে হঠাৎ কলেরা মহামারী শুরু হল, ডাক্তার বাবুর শহরে যাওয়া তো দূর বাড়িতে থাকারও সুযোগ নেই। ৭ গ্রামের মানুষকে বাঁচাতে তার ছুটে চলা। এদিকে তার নিজের অবস্থার অবনতি হচ্ছে। গ্রামের বিজ্ঞজনদের সিদ্ধান্ত হলো ডাক্তার বাবুকে তো গ্রাম থেকে যেতে দিলে এদিকে লাশের বন্যা হয়ে যাবে। তাই উনাকে গ্রামেই থাকতে হবে, আর মণ্ডল পুত্র আর তার দল যাবে কলকাতা। তারা কলকাতা থেকে বড় ডাক্তার নিয়ে আসবে গ্রামের অসুস্থ ডাক্তার বাবুর জন্য।

কলকাতা মণ্ডল পুত্র গেলো ঠিক কিন্তু কোন ডাক্তার আনতে পারলো না। কিভাবে বা পারবে, কলকাতার বড় ডাক্তারদের দিনে তখন একশত থেকে একশত কুড়ি  আয়, রোগি দেখলে কেউ ৫টাকা কেউ ১০টা ভিজিট নেয়। আর এদিকে গ্রামের সেই এম.এল.এফ ডাক্তার বাবু গ্রামের সাধারণ রোগী দেখেন কেউ চার আনা, কেউ আট আনা দেয়, কেউ ধান দেয় আর যদি জমিদার বংশের কাউকে দেখেন তাইলে ওরা এক-দু'টাকা দেয় আর কি। শহরের ডাক্তার বাবুকে গ্রামে এনে চিকিৎসা করিয়ে নিয়ে যেতে অন্তত তার দুদিনের কামায় দিতে হবে মানে দুইশত টাকা। গ্রামের গরীব মানুষের কি আর সেই  টাকা দেওয়ার ক্ষমতা আছে!

মণ্ডল পুত্র ফিরে এলো, ডাক্তার বাবু লাঠি নিয়ে একজনের হাত ধরে চলছেন। বুঝতে পারছেন উনার সময় খুব বেশি নেই। এক রাতে উনি চুপিসাড়ে গরুর গাড়িতে রওনা হলেন গঞ্জের দিকে, কলকাতা যেতে হবে সেই প্রচেষ্টায়। গরুর গাড়িটা দুই গ্রাম পার হয়েছে, হঠাৎ এক বাড়ি থেকে চিৎকার, "ডাক্তার ডাকো ডাক্তার ডাকো।" বাড়ি থেকে দুইটা ছেলে হারিকেন নিয়ে ডাক্তার বাবুর গ্রামের দিকে ছুট দিলো। গরুর গাড়িতে ডাক্তার বাবু সে গ্রাম পার হয়ে শেষ মাথায় পৌঁছাতে ঐ বাড়ি থেকে প্রচণ্ড কান্নার শব্দ আসতে লাগলো। ডাক্তার বাবু বুঝলেন ঐ বাড়ির রুগীটা গত হয়ে গেলো।

উনার মাথায় পুরোনো চিন্তা আবার নাড়া দিল। চিকিৎসার জন্য যে উনি কলকাতা যাবেন হয়তো সপ্তাহখানেক থাকবেন না তার মাঝে এই কয়েক শত মানুষের কি হবে? তাদের কে চিকিৎসা দিবে? কলেরার প্রকোপে গ্রাম শেষ হয়ে যাবে না তো? উনার বাবা বলেছিল, ডাক্তারের ধর্ম হলো আমৃত্যু রুগীর সেবা করা। এই ব্রত উনাদের এম.এল.এফ কোর্স শেষেও একবার শপথ পাঠে বলেছিল। ভেজা চোখে ডাক্তার বাবু গাড়ি ফিরাতে বললেন। ফিরে এলেন উনার বাড়িতে প্রচণ্ড বেহাল অবস্থায়।

ডাক্তার বাবু আর উঠতে বা বৈঠকখানায় রুগী দেখতে যেতে পারেন না। বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুনেন আর ঔষধ বলে দেন। এক গ্রাম, ঐ গ্রাম থেকে আশেপাশে থানা থেকে উনার মত এম.এল.এফ ডাক্তার আর কবিরাজ অনেকেই এলো উনার চিকিৎসা করতে। বিধাতার পরে সাত গ্রামের মানুষের একটাই আশা এই ডাক্তার বাবু। তবে শেষ রক্ষা হলো না। ডাক্তার বাবু বিদায় নিলেন, বিদায়কালে উনার পুত্রকে কলকাতা যেয়ে এম.এল.এফ করে আসতে বললেন কারণ উনার পরে এই অত্র অঞ্চলে আর যে ডাক্তার নেই।

আচ্ছা, শহরের ডাক্তার বাবু কি পারতেন না দু'টো দিনের কামাই বিসর্জন দিয়ে গ্রামে এসে ডাক্তার বাবুকে একটু দেখে যেতে? ডাক্তার বাবু যে ঐ রাতে গাড়ি ফিরালেন তা কি ঠিক করেছিলেন? নিজের জীবনের থেকে বেশি গ্রামের মানুষের কথা ভাবাটা কি ঠিক সিদ্ধান্ত? ডাক্তার বাবুকে কি বিধাতা রক্ষা করতে পারতেন না? উনি কি জানতেন না যে এত গুলো মানুষের সেবায় মাত্র এই একজন ডাক্তারই আছেন?

এমন কয়েক'শ প্রশ্ন গুনগুন করতে থাকলো সমস্ত অঞ্চল জুড়ে। জানা জানিয়ে হয়ে কলকাতার কিছু বড় ডাক্তার বাবু আবার বললেন যে উনি জানলে নাকি যেতেন ডাক্তার বাবুকে দেখতে।

কিছু দিনেই আব মিশে গেলো। গ্রামের মানুষ অসুস্থ হলে ঐ দূরের গ্রামের কবিরাজের কাছে যান আর অপেক্ষা করেন ডাক্তার বাবুর পুত্র কবে কলকাতা থেকে ডাক্তার হয়ে ফিরবে...

©মাহিন - আল বিরুণী

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ