অভাগী মালিনী (এই শরীর, গল্পের শেষাংশ)

আমার জীবনের এই গল্পটা, অনেকদিন কেটে গেল শুনাবো শুনাবো করে শুনানো হয়নি। সত্যি বলতে গেলে কোন দিক থেকে শুরু করি না করি খুব দোটানা হয়ে যায়। বছর দেড়েক আগের আমি তখন আমার ভাতিজি,  আরোহীকে স্কুলে দিয়ে ক্যাম্পাসে যাই। আরোহীর কাছে স্কুলে এই হলো, সেই হলো, অমুকের সাথে বসি না, তমুক বেস্ট ফ্রেন্ড ইত্যাদি গল্পের মধ্যে শুনেছিলাম ইলা ম্যাডামের কথা। ম্যাডাম খুব সুন্দর গল্প বলে, মজা করে, হাসিতে নাকি পেট ফেটে যায় তার ক্লাসে। স্বাভাবিক ভাবেই একটা ইচ্ছা ছিল এই মহিলাকে একটু চিনার। একদিন সকালে আরোহীকে স্কুলের গেটে ছাড়ছি, ঠিক সেই মুহূর্তে আরোহী বলে উঠল মিস মিস। দেখলাম চশমা পরা একটা উজ্জ্বল শ্যামলা মহিলা, উদাস চোখে তাকিয়ে আমার আরোহীকে দেখে পলকের মধ্যে মুখে একটা হাসি একটা সজীবতা নিয়ে আসলেন তিনি। সদ্য সঙ্গীনি হারানো আমার জন্য চট করে মুখে হাসি নিয়ে আশাটা যেমন অবাস্তব ছিল তেমনি উনার হঠাৎ হাসতে পারাটা ছিল আকর্ষণীয়।

আরোহী তার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। বলা শুরু করে চাচু তোমাকে তো বলি এইটাই ইলা মিস। জানো উনি হেবি গল্প বলেন এই সেই..........। তারপর ইলা শুরু করল, "আপনার ভাতিজি অনেক ভালো। আমার ক্লাসে তো খুব এটেনটিভ। তবে একটু হৈচৈ প্রিয় সে।"
আমি, "ছোটবাচ্চা তো। একটু হাসি খেলা তো করবেই। ওদের এই তো বয়স।"
আমি আমার নিজের পরিচয় দিয়ে হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়ালাম। তার চোখে আবার সেই উদাস ভাবটা এক ঝলক দেখতে পেলাম। তারপর পরই সে হাসি দিয়ে হ্যান্ডশেক করল। আমার কেনো জানি তার উদাস হওয়া আবার চট করে হাসি দেওয়ার রহস্য জানতে ইচ্ছা হল। আমারও ঐভাবে চট করে মুখে হাসি আনাটা শিখার ইচ্ছা হল। গত কয় মাস থেকে আমি যে ঠিক মত হাসতে ভুলে গেছি। আমারও তো হাসতে ইচ্ছা করে।

স্বাভাবিক ভাবেই চলছিল সব। আমি আরোহীকে স্কুলে দেই, নিয়ে আসি। ঘটনা ঘটল আরোহীর স্কুলের পিকনিকে। ভাইয়া ভাবি কেউ সাথে যেতে পারবে না। আর আরোহী তো কোনো ভাবেই পিকনিক মিস দিবে না, আর মিস দিতে ওকে বলবও না। তাই সিদ্ধান্ত হল ওর সাথে আমি যাব পিকনিকে। আমার ইদানিং অতিরিক্ত জনসমাগম পছন্দ না; আমি একটু একা থাকতে চাই। মাঝে মাঝে বসে বসে একটা সিগারেট ধরাই। আমার দিন এভাবে বেশ চলে যাচ্ছে। অতিরিক্ত জনসংখ্যা বিশিষ্ট স্থানে যেয়ে আমার মেজাজ খারাপ করার বা কারো নজরে পড়ার কোনো আগ্রহ নেই। তাও আরোহীর জন্য ভিতরের কথা ভিতরে রেখে, নিঃশব্দে আমাকে রাজি হতে হল।

পিকনিকের দিন সকাল নয়টায় বাস চলা শুরু হল।বাচ্চাদের হৈচৈ চলছে। বাসের মধ্যে কখনও গান, কখনও কৌতুক চলছে। আর এই হৈচৈ এর প্রধান ম্যানেজার হলেন ইলা মিস। আমি সারাটা সময় জানতে অজানতে তাকে দেখেছি, এক দুপলক এদিক সেদিক গেলে খুঁজেছি। ছাব্বিশ সাতাশ বছর বয়সী এক মহিলার এমন চঞ্চলতা আমাকে কৌতুহলী করছে বারবার। কয়েকবার তার বোধশক্তিতে প্রশ্ন উঠল মনে মনে। এর মধ্যে আরোহী একবার সিট থেকে উঠে কয়েক সিট সামনে ওর ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলতে গেল, বাচ্চাটা আমার হৈ-হুল্লোড়ের পোকা! আমার পশে সিটটা ফাঁকা হয়ে যাওয়ায়; কথা বলতে বলতে ইলা মিস এসে বসল আমার পাশে। চোখের চশমাটা হটিয়ে কয়েকটা সেই উদাস শ্বাস নিয়ে আমার দিকে তাকাল। আমাকে তার দিকে খেয়াল করতে দেখে অন্য দিকে একটু তাকিয়ে আবার, আবার সেই অদ্ভুত ভাবে স্বাভাবিক হাসি দিয়ে জিজ্ঞাসা করল কেমন আছি। আমাকে কথায় কথায় জানালো তার বাসা কোথায়। বাসায় নাকি কেউ নাই। তিনি একবছর হল মাস্টার্স কমপ্লিট করেছেন। এই স্কুলের নাকি তিন বছর আগে গেস্ট টিচার আর বর্তমানে ফুলফর্ম টিচার হিসেবে আছেন। কিন্তু আমার প্রশ্ন তো সেটা নয়। আমার মনে হচ্ছিল আমি পারলে তাকে যেন দুভাগ করে দেখি তার ভিতরে কী আছে। এই উদাসী হওয়া আবার হাসি দেওয়ার মধ্যকার রহস্য কী। আর এই হাসি দেওয়ার উপায়টা কী।

আমাদের তিন ঘন্টার যাত্রা শেষে পিকনিক স্পটে পৌঁছালাম। আরোহীকে এদিক সেদিক সব ঘুরিয়ে এনেছি। এখন বাচ্চারা নিজেদের মধ্যে ব্যস্ত। দুপুরের দিকে বাচ্চারা বিভিন্ন গেমস খেলছে। ঠিক সেই সময়ে আমি অনেকটা আড়ালে যেয়ে একটা সিগারেট ধরিয়েছি, এক মিনিটও হয়নি, ইলা এসে হাজির।
বলল, কী হচ্ছে এইখানে?
আমিঃ কই কী?
ঃ হাতে কী আপনার?
ঃ বাদ দেন
ঃ কী বাদ দিব? বলে ইলাকে উদাস হতে দেখলাম আবার। একটু থেমে আমি সিগারেটটা ফেলে চলে আসলাম।
ফেরার পথা উনার নম্বরটা চাইলাম। দিয়েছিলেন।

পিকনিক থেকে আসার এক সপ্তাহ পর আমি উনাকে এক রাতে ফোন দিলাম। কথা শুরু হল। জানতে পারলাম উনি মেডিক্যালি আমার চেয়ে দুই বছরের বড়। আমি যে স্কুল থেকে মাধ্যমিক দিয়েছি উনি নাকি নাইন পর্যন্ত সেই স্কুলেই ছিলেন। আমাদের কথাবার্তায় বন্ধুত্ব হয়ে গেল। আমি নিজেকে কেন জানি ভেঙ্গে উনার সামনে তুলে ধরলাম।  আমি উনাকে বললাম যে আমার এখন কিছু ভালো লাগে না। একটু শান্তির চাহিদা আজ মনে প্রচুর পরিমাণে। একটা ভাতিজি সেইটা নিয়েই সময় পার করা। সারাদিন ক্যাম্পাস আর বিকেল থেকে রাত কিছু পার্টটাইম কাজ করি। এই আমার জীবন। আমার জীবনে এর আগে যে ছিল সে দীর্ঘদিন সঙ্গে ছিল। আমি তাকে হারাব এইরকম ভাবিনি কোনোদিন। তাকে খুব দরকার আমার। আর ইলার বারবার মুহুর্তের মধ্যেই হেসে ফেলার টেকনিকটাও আমার দরকার। সেইদিন সে তেমন কিছু বলল না।

দুইদিন পরে শুক্রবার ছিল। এই দুইদিনই আমাদের ফোনে কথা হয়েছে। ইলা আমাকে দেখা করার কথা বলল। লেকের ধারে দেখা করলাম দুজনা। ততক্ষণে আমরা তুমি করে কথা বলি। লেকের ধারে বসে বাদাম আর গল্পের মাঝে ইলা বলল, তুমি তো আমাকে অনেক কিছু বললা আমি আজ কিছু বলি তোমাকে। ইলা বলা শুরু করল, আমার বিয়ে হয়েছিলো আড়াই বছর আগে। দুই বছরের বন্ধুত্ব আর তিন বছরের প্রেমের পরে বিয়ে। শুরু থেকেই আমি তার দুনিয়া ছিলাম। হ্যাঁ, তার দুনিয়া ছিলাম আমি। প্রতি মুহূর্তে তার জন্য আমি ছিলাম সব। বিয়ের পর আমার জীবন, আমি আমার কাজিনদের দোয়া দিতাম আমার মত সংসার যেন তোদেরও হয়। সব ভালোই ছিল কিভাবে কী হল জানি না। যার দুনিয়া আমি ছিলাম সেই মানুষটার নাকি আমাকে আর ভালো লাগে না। তার ফ্রেন্ডস তার এই, তার ঐ সব ভালো লাগে শুধু আমি হলাম ভালো না লাগার মানুষ। সে নিজেও বলতে পারেনি যে কি হচ্ছে। শুধু আমাকে আর ভালো লাগে না বলে চলে গেল। তারপর ডিভোর্স। আজ আট মাস।

এই প্রথম আমি ইলাকে এত বেশি সময় উদাস থাকতে দেখলাম। আমি একটা সিগারেট বের করে ইলার দিকে তাকালাম। সে একটা হাসি দিয়ে অন্য দিকে তাকাল। আরো অনেকটা সময় আমরা ঐ ভাবে চুপচাপ বসে থাকলাম। সন্ধ্যায় ওকে বাড়িতে রেখে, আমি বাসায় আসলাম।

দিন যেতে থাকে আস্তে আস্তে আমাদের কথা বাড়তে থাকে। কথায় কথায় অনেকটা কাছাকাছি হয়ে আসি আমরা। আমরা প্রেমে পড়েছি কিনা জানি না। দেখা করা, এক সাথে ঘুরা ঘুরি, বাজার করা আর অবশ্যই একটু একে অপরের খেয়াল রাখা চলতে থাকে‌। দিন দিন বাড়তে থাকে।যতটুকু সঙ্গ, অতীতের অনুপস্থিতি অনেকটা ঢাকা আর একে অপরের অনুপ্রেরণা হওয়ার জন্য লাগে। আসলে আমরা একে অপরের জন্য হয়ত কারো অভাব মিটানোর একটা মাধ্যম হয়েছিলাম। সাইকোলজি বলে যদি আপনার সিরাগেট খাওয়ার নেশা থাকে আর কোনো কারণে আপনি সিগারেট না পান, তাহলে যখন সিগারেট না পাওয়ার নেশা আপনাকে পাগল করে তুলে সেই সময়ে যদি আপনি কফি খান, তাহলে সিগারেটে যে তৃপ্তি পেতেন তা হয়ত পাবেন না। কিন্তু সিগারেট না পাওয়ার যন্ত্রনাটুকুও তেমন অনুভব করবেন না। আমাদের বিষয়টা ঠিক সেই রকম।

জীবনে ইলার গুরুত্ব অনেকটা বেশি হয়ে যায়। হ্যাঁ, ফ্রেন্ডশিপ, কিন্তু ফ্রেন্ডের থেকে বেশি আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায় সে। কিছু মানুষ লাগে জীবনে চলার জন্য আর কিছু লাগে চালানোর জন্য। তারপর বসে মনের সাথে মাথার মিটিং। আলোচনার বিষয় অনেক। একদিকে, সে ডিভোর্সি, বয়সে বড়। অন্যদিকে, আমারও পাস্ট আছে। মধ্যে, তার সাথে আমার চলে, আমাদের একসাথে ভালো থাকার সম্ভাবনা আছে। নানা যুক্তিতর্ক হল নিজের সাথে। তারপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলাম। তখন মনে সমাজ আর ইলার সাথে যুদ্ধের ভয়।

ইলাকে ফোন দিলাম খুব কৌতুহলের সাথে প্রথমেই প্রশ্ন, কী হয়েছে? কাল থেকে ফোন ধরো না কেন?" আমি খুব শান্ত ভাবে বললাম, "দেখা করো।"
বিকালে দেখা হল। ইলার চোখে, ঠোঁটে আজ উদাসী ভাব নাই আবার মিষ্টি হাসিও নাই৷ আজ শুধু কৌতুহল। আর এই কৌতুহলের কারণটা আমার স্পষ্ট জানা। আমি ওকে বললাম, "ইলা আমার সম্পর্কে সব তোমার জানা৷ আমি বলেছি তোমাকে সব। আমি তোমার সঙ্গ চাইছি, দিবা কি?" ইলা খুব কনফিউজড চোখে বলল, "কিসে সঙ্গ?" আমি সব কিছু বললাম। ইলা তখন অবাক, ওর চোখে একটা আনন্দ মিশ্রিত। তার মধ্যে বলল, যদি সেটা সম্ভব হত আমি খুব খুশি হতাম সত্যি। কিন্তু তা যে সম্ভব না। হ্যাঁ, তুমি মেনে নিলা কিন্তু সমাজ? তার থেকে বড় তোমার পরিবার? আমি ওকে সব বুঝিয়ে বললাম। ও যে আজ বুকের মাঝের একটা ফাঁক হওয়া যাওয়া স্থানের গর্তটা ভরাট করে রেখেছে আরও কত কত কিছু। সব শুনে ও বাসায় গেল। রাতে ফোন দিলাম, ধরে না। পরের দিন সকালে ফোন দিলাম ধরে না। দুপুরে ওর স্কুলের সামনে গেলাম। আমাকে দেখে অন্য দিক দিয়ে চলে যেতে লাগলো। আমি তাড়াতাড়ি যেয়ে হাত চেপে ধরলাম। খুব অসহায় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাস করল, করুণা করতে এসেছ আমাকে? আমি তো তা চাইনি। আমি হাত ছেড়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম।

পাঁচ মিনিট পরে দেখি ওর ফোন। ধরতেই জিজ্ঞাসা, কোথায় তুমি? বললাম, সিগারেটের দোকানে। বলে দাঁড়াও ঐখানেই। এসে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল আমার দিকে। প্রশ্ন করল, ভালোবাসো আমাকে? আমি বললাম, ভালোবাসি কিনা জানি না। তবে তোমাকে যে জীবনসঙ্গী হিসেবে চাই তা সত্য। বলল যে ওর কেনো জানি বারবার মনে হচ্ছে আমি ওকে করুণা করছি। ওর কাছের খুবই কাছের মানুষ গুলো ওকে অভাগী বলে, ওর কপালে দোষ আছে। নাহলে কেন এত সুন্দর সংসার ভেঙে যাবে। আমার উত্তর ছিল, কারো বলা আমি ভাবতে চাইনা। কিন্তু অন্যদের কাছে অভাগী হলেও আমার জীবনের অগোছালো হওয়া অনেক কিছু সে সাজিয়ে ফেলেছে। আমার জীবনে সে মালিনী, জীবন বাগানের মালিনী। সারাটা বিকাল-সন্ধ্যা ওর সাথে থেকে ওকে অনেক কিছু বলে বুঝিয়ে আসলাম। আশার সময় ওর চোখে আবার সেই একটু বিষণ্ণতা দেখলাম। রাত একটার দিকে হঠাৎ ওর ফোন।
আমি, "হ্যালো"
ঃ আমার আগে প্রেম না একটা সংসার ছিলো।
ঃ জানি।
ঃ তোমার তো তেমন ছিল না।
ঃ জানি।
ঃ তাহলে কীভাবে আমাকে.........। তুমি সিউর?
ঃ কালই আব্বু আম্মুর সাথে দেখা করালে বিশ্বাস করবা।
কয়েক মিনিট নিরবতা।
ঃ সিগারেট খাওয়াটা ছাড়বানা?
ঃ খুব কষ্টকর
ঃ আমাকে পেতে হলে ঐটা অন্তত কমাতে হবে। দিনে কয়টা লাগে?
ঃ দশ বারোটা।
ঃ কাল থেকে পাঁচটার বেশি না।

তারপরে পরিবারের সাথে কিছুটা ঝামেলা হয়েছে কিন্তু ওর সাথ পেয়ে অনেক ধৈর্য আর চেষ্টা দিয়ে সবাইকে রাজি করাতে পেরেছি। এখন ক্যালেন্ডারে রোজ তারিখ দেখছি। ওকে লাল শাড়িতে সাজিয়ে ঘরে তুলে আনতে কয়টা দিন পার হওয়ার অপেক্ষা।

মাহিন - আল বিরুণী
২৫শে মে, ২০১৯




মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ