আন্তঃনগর মঙ্গযান

Painting © Urba Riazi
আন্তঃনগর মঙ্গযান ট্রেনটা গত বছরের শেষ থেকে ফটিকছড়ি স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে। উনিশশো বিয়াল্লিশ সালে ততকালীন ব্রিটিশ কোম্পানি ট্রেনটা এনেছিল। সে সময় একটি অত্যাধুনিক ট্রেন হিসেবে এই ট্রেনটি; ঢাকা-সৈয়দপুর লাইনে চলাচল করত। গত ছিয়াত্তর বছরে বিভিন্ন রুটে ট্রেনটা চলেছে। গতবছর যেদিন এই স্টেশনে আসে সেদিনও যাত্রী বোঝাই হয়ে এসেছে, তবে আর যাওয়া হয়নি, স্টেশনের একটা পরিত্যক্ত লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে গেছে। প্রথম ভেবেছিল যে হয়ত সাময়িক যাত্রা বিরতি বা পরিষ্কার-পরিছন্নতার কাজে তাকে এই লাইনে আনা হয়েছে তবে দেখতে দেখতে যখন তার ড্রাইভার, হেল্পার, টিটি, শেফ সবাইকে দেখল একে একে অন্য ট্রেনে পোস্টিং নিয়ে চলে যেতে। তখন তার মনেমনে ভয় হল তাকে কি তবে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হবে! তা হলে ট্রেনের বডিটা তো কোনো স্টিল কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেওয়া হত। কিন্তু তা হল না। প্রতিদিন স্টেশনে হাজার হাজার লোক আসে-যায়। লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা এই অচল ট্রেনটাকে দেখে প্রথমে কারো মাথা ব্যথা না হলেও কিছুদিনের মধ্যেই কিছু লোকাল ছেলে ট্রেনের ছাঁদে উঠে তাস খেলার আড্ডা বসালো। কয় মাস যেতে না যেতে ট্রেনের বন্ধ জানালার একটা ভেঙে, সেই বগিতে কিছু নেশারি নেশা করা ধরল। এর মধ্যেই ট্রেনের দায়িত্ব পাওয়া কেয়ার টেকার শেষ কবে ট্রেনটার ধারের কাছে এসেছিল তা উনার নিজেও মনে নাই। ট্রেনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বাচ্চারা এটা সেটা দিয়ে গুতা দেয়, হাতের লাঠি দিয়ে বাড়ায়, কেউ ঢিল ছুড়ে দেয় আরো কত কি। এসবের ফলে ট্রেনের রঙ চটে যাচ্ছে, কোথাও কাঁচ ভেঙে যাচ্ছে আর নিয়মিত অত্যাচারে কয়টা দরজার তো যেন খুলে পড়ল কি পড়ল। অন্যদিকে রাতে বৃদ্ধ আর ঘরহীন মানুষের ঠাঁই হয়েছে এই ট্রেনের নিচে আর ভাঙা জানলা দিয়ে ঢুকা যায় এমন দুইটা বগিতে। এ বিষয়টা আবার ট্রেনের জন্য খুব ভালো লাগার। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে যে ট্রেনটা এখানে দাঁড়িয়ে আছে তার কোনো যত্ন নেওয়া হয় না।

হঠাৎ রেলে নতুন নিয়োগ প্রাপ্ত এক তরুণ অপারেশন অফিসার স্টেশন ভিজিটে এলেন। তিনি ট্রেনটিকে ভালো করে দেখে, খোঁজ খবর নিলেন। জানতে পেলেন এই ট্রেনে আগে এগারোটি বগি ছিল। পরে এর ইঞ্জিনের ধারণ ক্ষমতার অবক্ষয় হলে আস্তে আস্তে বগির সংখ্যা কমানো হয়। শেষ কিছুদিন এটি ছয়টা বগি নিয়ে চলাচল করেছে। আসলে ধারণ ক্ষমতা কমলে ট্রেনের নাড়ির সাথে জোড়া লাগানো বগি গুলোও আলাদা হতে থাকে। সে বগি গুলো অন্য সচল ইঞ্জিনে সংযুক্ত করা হয়। অপারেশন অফিসার বললেন, এই অচল জিনিস দিয়ে রেললাইন বন্ধ করে রেখেছেন কেন? এইটা দ্রুত সরিয়ে লাইন ক্লিয়ার করেন। উনাকে জানানো হল এই লাইনটা পরিত্যক্ত। উনি তারও জবাব দিলেন বললেন দেশে বর্তমানে যেভাবে রেলে দূর্ঘটনা ঘটছে, তার থেকে পরিত্রাণ পেতে কিছু লাইনও নতুন করে বসানো হবে। সে সময় উনি এই লাইন ঠিক করিয়ে দিবেন। উনি ট্রেনটা চালু করার ব্যবস্থা করতে বললেন আর ট্রেন ম্যানেজমেন্টে জানালেন উনি এইটা নিয়ে আসছেন। উনার সিদ্ধান্ত হল এই ট্রেনটা এইবার স্টিল কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দিতে হবে। ওরা এটাকে গলিয়ে ধাতু গুলো দিয়ে অন্য কিছু বানাবে।

যথারিতি সব কাজ শেষ করে, অফিসার ট্রেনটিতে চড়ে রওনা হলেন। ট্রেন জানে না তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তবে এতদিন একই স্টেশনে বিনাযত্নে আর বিনাকারণে থেমে থাকা যে বড় ভুল হয়েছে তা সে জানে। এই থেমে থাকা যে তাকে শুধুই মূল্যহীন করেছে এটা স্পষ্ট বুঝে সে। এই অফিসার যে তাকে ভালো কোথাও নিয়ে যাবে না এই ধরণাও কেন জানি তার হয়েছে! তার মনের ভিতরে অফিসারের উদ্দেশ্যে কিছু ভাসছিল। কথা গুলো এমন যে,
হেই অ্যংরি ইয়াঙ ম্যান একটু শুনুন আমার কথা। একদিন আপনাকেও এভাবেই কিছু অ্যংরি ইয়াঙ ম্যান নিয়ে যাবেন শ্মশানের দিকে। তাই বলছি একটু ধীরে গেলেও পারেন। আমার কাছে কত শত মানুষ ছুটে এসেছে। আমি চলে না যাই, সেই ভয়ে কত কার ঘন্টার পর ঘন্টা স্টেশনে বসে থাকা। মানুষের কোনো প্রয়োজন স্টেশন মিটাতে পারে না, প্রয়োজন মিটাতে পারে ট্রেন। তাও সবাই স্টেশনেকে ঠিকানা করে, ট্রেনকে না। মানতে পারিনি তবে এটাও জানি, এক স্টেশনে বেশিক্ষণ থামতে হয় না। কারণ ট্রেনের সাথে কারো মায়া হয় না। ইঞ্জিনে জং ধরে যাবে তখন ট্রেন আর যেতে পারবে না। যতক্ষণ ট্রেন চলতে পারে ততক্ষণই ট্রেনের কিছু মূল্য থাকে।



আন্তঃনগর মঙ্গযান

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ