কল্পনিতা ১ আগস্ট, ২০২৩

১ আগস্ট, ২০২৩


রবীন্দ্র সরোবর, ঢাকা।



কল্পনিতা,


আমার ডাইরিতে দু'টো পাতা ছিল, আমি শতবার চাইলেও বছরের পর বছর সে পাতা দু'টো ছিড়ে ফেলে দিতে পারিনি। এত আনন্দে লিখেছিলাম আবার এত বেদনায় লিখেছিলাম যে সেগুলো ফেলে দিতে বা রেখে দিতে উভয় দিকেই ধর্ম সংকট। মানে ধরো আমাদের একশ বছরের জীবন তাতে ছত্রিশ হাজার পাঁচশোটা তারিখ আসে। এর মাঝেই কিছু তারিখ এত বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে যায় যা আমাদের মন নিজে নিজেই মনে রাখে, বারেবারে মনে রাখে।



বাড়ি থেকে প্রায় তিনশো কিলোমিটার দূরে আজ ২০মাস আগে আমি যেখানে আস্তানা গেঁথেছি, সে আস্তানার পিছনে গুটিকয়েক কারণ, স্বার্থ আছে। এইসব স্বার্থ হাসিল হয়ে গেলেই হয়তো আমাকে আর এখানে দেখা যাবে না। আমি ফিরে যাবো আমার আপন ঠিকানায়, যেখানে বাতাসের গন্ধ আমার চেনা, আর যেখানে নদীর পাড়ের ঢেউয়েরা আমাকে চিনে। স্বার্থের পিছনে ছুটে চলার এই দৌড়ে কিছু ভুল সাংঘাতিক হয়ে গেছে। জীবনের সিংহভাগই ভুলে ভরা এইটা জ্ঞানীজনে বলে তবে ভুলের মাঝে কিছু সাংঘাতিক ভুল হয়ে যায় যা আসলে প্রচণ্ড পুড়ায়। এই পুড়ে সোনা হতে পারার সম্ভবনা কতখানি তা জানি না, তবে পুড়তে পুড়তে ধাতু যে গলে যাচ্ছে তা দেখতে পাচ্ছি।



ছোটবেলায় আমি যখন সকাল ৬টার পরপর স্কুল ভ্যানে উঠে যেতাম আর বেলা ১টার পর আবার ফিরে আসতাম, মোটামুটি একাকী একটা জীবন পার করতাম। টিভি, কম্পিউটার এর মত কিছু যন্ত্র আমার বন্ধু ছিল। সে সময়ই আমার গান শোনার নেশা আর আস্তে আস্তে কবিতার প্রতি অনুরাগের উদয় হতে শুরু করে। এই একাকী থাকা প্রথম প্রথম বা সিয়ানা বয়সে মজা লাগলেও সে সময় খুব একটা মজার ছিল না। আমি অপেক্ষায় থাকতাম, আমি ঘড়ি পড়ি সম্ভবত স্কুলে ভর্তি হওয়ারও আগে থেকে। আমি ঘড়ি দেখতাম। আমি অপেক্ষায় থাকতাম আমার দু'জন বন্ধুর ফিরে আসার। তারা ফিরে আসলে আমি বাসায় যেতাম। তেমন আলিশান কিছু না, তবু আমার বাসা।



প্রচন্ড ঘরমুখো আর এককোণে থেকে যাওয়ার স্বভাব আমার। চুপচাপ কোথায় আছি তো আছিই। আমার দুই বন্ধুর সাথেই আমার কম বেশি কথা, ঝগড়া আর রাগ ঝামেলার সব। তাদের বাহিরে আমি যে বন্ধু করিনি তা না, তবে সেটা খুবই কম। সত্যি বললে প্রয়োজনের প্রিয়জন বলে যে কথাটার এখন প্রচলন হয়েছে। সেই কথাটা আমি তখন থেকেই অনুভব করতাম।



চোখে স্বপ্ন নিয়ে সবাইকে পিছনে ফেলে আমি একা, একযোদ্ধার মত ছুটে এসেছি এই শহরে। এখানে আমার রক্তের আত্নীয় বহুত আছে, আমার প্রয়োজনের প্রিয়জন বন্ধুও অনেক আছে তবে আমার সেই বন্ধু দু'টো নেই। আমি যে চিন্তাধারা আর যে পরিবেশে বেড়ে উঠেছি তার থেকে অনেক বিপরীত মুখী একটা সংস্কৃতির মাঝে এসে আছি এইখানে। যদিও দিন চলে যাই ২৪ ঘন্টায় কিন্তু ঐ যে টানা একটা একাকীত্ব, নিজের সব কথা খুলে বলার সেই বন্ধু দু'টো কাছে না থাকার যন্ত্রণাটা প্রচন্ড।



আমি যে স্বপ্ন নিয়ে এসেছিলাম তা বদলে নতুন স্বপ্ন দেখতে হচ্ছে, আমি সে আশা নিয়ে এসেছিলাম যে আশার ফানুস উড়ে গেছে। আমার সরল মন আর অসুস্থ হৃদয় মেনে নিতে নিতে নেতিয়ে গেছে অনেকখানি। তবু কাপ্তানে দারিয়া হাল ছাড়েনি। তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দিতে বদ্ধপরিকর। সমস্যা হলো ঐ যে বন্ধুরা কেউ কাছে নেই, অসুস্থ হৃদয় নিতে পারে না সব সময়, তখন ঝিমিয়ে যায় সব। দিনের শেষে একটু গল্প করার, একটু অনুপ্রেরণা জোগানোর সে মানুষ গুলোকে ছাড়া দিন, সপ্তাহ হয় কাটিয়ে দেওয়া যায় তবে মাস কিংবা বছর কাটানো কঠিন আছে। নাইলে কি আর মানুষ সামাজিক জীব!



যে সরল আর সত্যের পথে আমি হেঁটে রজতজয়ন্তী পার করেছি, সে পথ তো আমি সহজে ছেড়ে দিতে পারবো না। সত্যি বললে, দিবোও না কারণ আমি জানি আমি ঠিক, আমি সঠিক পথের পথচারী। কিন্তু সমস্যা হলো চারিদিকে শকুন, মধ্যে আমি। দিরে উড়ে চিল, রাতে ঘিরে হায়না। এদের মাঝে টিকে থাকার লড়াই করে যাও, একা হাতে লড়ে যাওয়া বড় শক্ত কাজ। এর মাঝে আরেকটা বন্ধু পাতিয়েছি। জীবন হয়তো বহমান থাকবে আরো বেশ কয়েক হাজার দিন তাই। সে বন্ধুও থেকে গেছে দূরে, পরিস্থিতির রাজনীতির শিকার হয়েছি আমরা। সব মিলিয়ে আমি ক্লান্ত, বিধ্বস্ত একটা অবস্থা।



অর্থ, সম্পদ, শরীরের থেকে অনেক অনেক বেশি প্রয়োজন মানসিক শান্তি। যারা দেহের ক্ষুধায় খুঁজে তারা চায় কচি ডাব, অনেক পানি। আর যারা মানসিক ক্ষুধায় ছুটে তারা চায় পরিপক্বতা, মানসিক সস্তির তৃপ্তি। 



-ইতি


মাহিন - আল বিরুণী 

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ