"ভেবেছিলাম আত্নহত্যা করব"

শুনে যারা পড়লেন না তারা ভালো করলেন। আর যারা পড়া শুরু করলেন তাদের, স্বাগত জানাচ্ছি। কয়দিন থেকে খুব আত্নহত্যা খবর আসছে তাই না? খবরে আত্নহত্যার খবর দেখে অনেকে খুব বিরক্ত হন। আসলে আত্নহত্যা মানে নিজেই নিজেকে মেরে ফেলা। এইটার অনেকগুলো শ্রেণী প্রকার আছে। তবে আমি(মাহিন) দুইটা প্রধান শ্রেণী লক্ষ করেছি। একটা হল, ১। হঠাৎ আত্নহত্যা 
আর একটা, ।২। সাইকোসিস আত্নহত্যা (মনোরোগে আক্রান্ত ব্যক্তির আত্নহত্যা)। আমার অনুরোধ যদি আমি আপনার পরিচিত এবং আপনার জীবনে এতটুকু জায়গার অধিকারী হই তবে পোস্টটা পড়বেন প্লিজ। তো ১নং, হঠাৎ আত্নহত্যা এইটা এমন যে, কোনো কিছু নাই হঠাৎ একটা কারনে চূড়ান্ত সীদ্ধান্ত নিয়ে আত্নহত্যা করে ফেলে। উদাহরণ, ঈদে পাখি ড্রেস কিনে না পাওয়ায় আত্নহত্যা করা। ২নং, সাইকোসিস আত্নহত্যা, এইটার বিষয়েই কথা বলার। এইসব আত্নহত্যাকারী দীর্ঘদিন থেকে বিভিন্ন মানসিক রোগে/সমস্যায় ভুগে আত্নহত্যা করেন। ধরেন ক্লাস ফাইভে এ প্লাস পায়নি, এইটে এ প্লাস পায়নি। এখন এইটের রেজাল্ট হওয়ার পরে আত্নহত্যা করে ফেলল। 

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই সাইকোসিস আত্নহত্যাকারী গুলো দীর্ঘদিন ডিপ্রেশনে ভুগেন। হ্যাঁ, আমাদের অতি পরিচিত শব্দ ডিপ্রেশন একটা মানসিক রোগ। অনেকের ক্ষেত্রে এইটা সাময়িক ভাবে কোনো কারনে হয়। কিন্তু যারা দীর্ঘদিন ধরে সাথে নিয়ে আছেন তাদের এইটা রোগে রূপান্তর হয়েছে। এই রোগের চূড়ান্ত সীমায় মানুষ আত্নহত্যার পথ বেঁছে নেয়। আর সিগারেট, মদ বা অন্য মাদকে আসক্ত হওয়াটা প্রাথমিক থেকে একটু উপরের পর্যায়ে শুরু হয়। শিক্ষিত লোকে বলবেন, যদি সাইকোসিস হয় তাহলে সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে যাবে। কিন্তু এখানে আছে নানা সমস্যা। প্রথম সমস্যা হল একজন সাইকোসিস নিজেও অনেক সময় বুঝতে পারেন না যে তিনি অসুস্থ। আর সকল প্রতিকূলতা পারি দিয়ে যখন কেউ সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে যান তখন সাধারণত আমাদের দেশে যা হয় (শুনে অনেক ডাক্তার আমার উপরে রাগ করবেন জানি। কিন্তু বাস্তবতাতে আমাদের দেশে এমনই হয় বেশির ভাগ) তা হল, রোগীকে কয়েকটা ঔষধ যেমন ঘুম, এন্টিডিপ্রেশন এর ট্যাবলেট লিখে দিয়ে আর হাল্কা কাউন্সিলিং করে আবার সপ্তাহ বা মাস পরে দেখা করতে বলা হয়। ঔষধের ক্ষেত্রে এইটাই ঠিক আছে কারন তার অসুখটা শরীরে না যে গাদাগাদা ঔষধ লাগবে। অসুখটা তো মনে। আর এই অসুখের প্রধান আর সব থেকে কার্যকর ঔষধ হল কাউন্সিলিং করা। দুঃখের বিষয় হলেও সত্যি যে আমাদের দেশে বেশির ভাগ সাইকোসিস তার সেই জরুরী কাউন্সিলিংটা ঠিকমত পান না। দেশের বড় বড় সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে কাউন্সিলিং করার মত যথেষ্ট সময় থাকে না আর যদি তা করতেই হয় তবে সাইকিয়াট্রিস্ট এর যা বিল হবে আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষই তা বহন করার ক্ষমতা রাখেন না। এখন একদিকে যে কাউন্সিলিং এর দরকার একজন সাইকোসিস তা ঠিক মত পাচ্ছেন না। অন্যদিকে যা হয় তা ঠিক উলটা। সাইকোসিস এর সাথে সমাজ আর পরিবেশ এমনকি পরিবার যে আচরণ শুরু করেন তা তার অবস্থা হিতে বিপরীত করতে যথেষ্ট। মানে ধরেন ঐ যে ছেলেটার রেজাল্ট খারাপ বলে ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হয়েছে। তার আশেপাশের সকল মানুষ পারতে পর্যন্ত যতবার সম্ভব তার সেই জায়গায়ই আঘাত করেন। মানে বারবার রেজাল্টের কথা বলেন, তাকে হীন দেখান। আর এইসব রোগীদের ঔষধ আর কাউন্সিলিং করে অবস্থার যেটুকু উন্নতি করা সম্ভব হয়, এমন দুই/একটা অপ্রীতিকর কর ঘটনা সেই সমস্ত উন্নতি পানিতে ফেলে দিতে যথেষ্ট। বলে রাখি অধিকাংশ ডিপ্রেশনের রোগীর এই রোগ ডায়বেটিস এর মত মানে নিয়ন্ত্রণে এসে অনেকটা ভালো থাকে। কিন্তু মুহূর্তে হঠাৎ বেড়েও যেতে পারে। এইটা একটা সাধারণ ঝুঁকি।  

চিকিৎসার প্রতিবন্ধকতা শুধু এই একটা স্থানে নয়। আমাদের দেশের অসচেতন মানুষের কারনে আরো প্রতিবন্ধকতা আছে। যেমন ধরেন আপনার পাশের বাসার আন্টি জানতে পেলেন যে আপনার কিছু সমস্যা তাই সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে গেছিলেন। আন্টি গোটাপাড়াতে ঢোল-তবলা পিটাবেন যে, ছেলেটা পাগল হয়ে যাচ্ছে। মাথায় সমস্যা! এখন এইসব আন্টি-আঙ্কেলের অত্যাচারের ভয়ে আপনার পরিবারও আত্নসম্মানের বিষয়ে খুব সজাগ হবেন৷ যার কারনে অনেক সময় আপনার পরিবারও আপনার সঠিক চিকিৎসা না হতে দিতে পারেন বা আপনার সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে যাওতা বন্ধ করতে পারেন! আবার অনেক সময় সাইকোসিস নিজে যখন নিজের সমস্যা বুঝতে পারে না কিন্তু আশেপাশে কেউ বুঝে তাকে সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে নিয়ে যায়, তখন সাইকোসিস ভাবা শুরু করে যে তাকে সবাই পাগল ভাবছে! আর এই ভ্রান্তি নিয়ে অনেকে নিজের অসুখ আরো বাড়িয়ে তুলেন৷ তবে এইটা স্বাভাবিক বিষয় এইটা সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে গেলে সাইকিয়াট্রিস্ট নিজেই বুঝতে পারেন আর ব্যবস্থা নেন। তো এই মানসম্মানের টানাটানির জন্য আবার ডিপ্রেশনের চিকিৎসা ব্যহত। অবাক করা সত্য এই যে দেশের অধিকাংশ শিক্ষিত মানুষও মানসিক সমস্যা সম্পর্কে সচেতন না বা এর চিকিৎসা নিয়ে হেলাফেলা করেন। বেশির ভাগেরই কেন জানি মনে হয় যে তিনি নিজে খুব ভালো বুঝেন। আর এইসব ঘোড়া রোগের ঔষধ-চিকিৎসা তিনি ভালো জানেন!

তো সকলের মান সম্মান, ঘোড়া রোগের চিকিৎসা ইত্যাদির মাথা-চোখ সব খুলে যখন হঠাৎ একদিন প্রিয়জনের লাশ ফ্যানের সাথে ঝুলতে দেখা যায়।

বর্তমান সময়ে অনেক গবেষণা হচ্ছে। আর গবেষণার ফলাফল খুব ভয়াবহ যেমন গত পাঁচ বছরে প্রতি বছর বাংলাদেশে আত্নহত্যাকারীর সংখ্যা বাড়ছে। প্রতিদিন বাংলাদেশে গড়ে প্রায় ৩০জন আত্নহত্যা করছে। আর গবেষণায় উল্লেখ্য যে আত্নহত্যাকারীদের মধ্যে শতকরা ৯৫জনই মানসিক আসুস্থতায় ভুগেছেন। আজ হঠাৎ আমার এই পোস্ট লিখার কারন হল, সামনে শীত আসছে, ইতিমধ্যেই দমকা বাতাস হচ্ছে। আত্মহত্যার হারের উপর মৌসুমী প্রভাবগুলি নিয়ে গবেষণা সুপারিশ করে যে শীত মৌসুমের শীত এবং অন্ধকার মাসে আত্মহত্যার হার চূড়ান্ত বলে সাধারণ ধারণা থাকা সত্ত্বেও বসন্তের শেষের দিকে এবং গ্রীষ্মের শুরুতে আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। অর্থাৎ আপনাদের আশেপাশে ডিপ্রেশনে থাকা পরিচিত মানুষগুলোর একটু খেয়াল রাখুন। কোনোদিন সকালে আপনার ঘুমও কারো কান্নার শব্দে ভাঙতে পারে। গত মাসে বাংলাদেশের অন্যতম একজন বিতার্কি। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) এর সাইফান ভাইয়ার আত্নহত্যা আমাদেরকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলন। মাত্র কয়মাস আগে একজনের আত্নহত্যা খবরে হাহা রিএক্ট দেওয়া সাইফান ভাইয়া নিজেই আত্নহত্যা করেছেন! অর্থাৎ আপনার সামনে হাসি-খুশি থাকা সকল মানুষ যে বাস্তবেই হাসি-খুশি আছে তা নয়। অনেকের এই হাসি ভরা চেহারার পিছনে একটা বিশাল ডিপ্রেসড মানুষ লুকিয়ে আছে।

তো আগামী কিছুদিনের মধ্যে আমি চেষ্টা করব আপনাদের সামনে এই বিষয়ে আরো কিছু তথ্য উপস্থিত করার। এক বছর আগে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি এই বিষয়টা নিয়ে সুযোগে কিছু কাজ করার। ব্যক্তিগত কিছু চেষ্টাও চালিয়েছি, তবে ছাত্র মানুষ তো অনেক ম্যানেজ করতে হয়।

আর হ্যাঁ, প্রথম যে লাইনটা দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম। সেইটা আজ প্রায় পাঁচ বছর আগের ঘটনা। ভেবেছিলাম না চেষ্টাও করেছিলাম, একাধিকবার। তবে উপরওয়ালার লীলা খেলায় আমার কোনোবারই ক্ষতি হয়নি। আর বর্তমানে আমি অনেক ভালো আছি। বিস্তারিত আলোচনা করতে না যাওয়াটাই ভালো। লজ্জা-ভয় অনেক কিছু কাটিয়ে আজ নিজের কথাটা প্রকাশ করে দিলাম শুধু যদি কারো জীবন বাঁচে সেই আশায়।  আমাকে ভালোবেসে সেই লাইনটা দেখে পোস্ট পড়েতে আশার জন্য ধন্যবাদ। সকলের সুন্দর জীবন কামনা করছি।


©মাহিন - আল বিরুণী


মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ